রেললাইনের পাশে মেয়েটার একটা হাত ধরে হাঁটছি। অন্য হাতে একগুচ্ছ গোলাপ ফুল। মেয়েটা অঝরে কেঁদে যাচ্ছে। হাঁটা থামিয়ে একটা বেঞ্চে বসলাম। মেয়েটার মাথায় হাত রেখে বললাম, “কি হয়েছিলো বল আমায়,বলবিনা” ?
মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে মুখ সরিয়ে নিল।জিজ্ঞেস করলাম, নাম কি তোর ?
“বকুল”, ক্ষীণ কণ্ঠে জবাব দিলো মেয়েটা।
আর কিছু বললাম না আমি। চুপ করে বসে রইলাম কিছুক্ষণ।
আসরের ওয়াক্ত হয়ে গেছে, মসজিদে আযান দিচ্ছে।মেয়েটা এখন আর কাঁদছে না। চুপচাপ বসে আছে আর মাঝে মধ্যে আমার দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখছে।সামনেই একটা বাদামওয়ালা বাদাম বিক্রি করছে।
জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে বাদাম খাওয়াবি ?
মেয়েটা সম্ভবত আমার প্রশ্ন বুঝেনি।জিজ্ঞেস করলো, কি ?
আমি আবার বললাম, বাদাম খাওয়াবি আমাকে ?
মেয়েটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। শেষে তার নিজের ছেঁড়া ফ্রকের কোনায় বাঁধা গিট্টু খুলার চেষ্টা করতে লাগলো।অনেকক্ষন চেষ্টা করার পর গিট্টুটা খুলে গিট্টুর ভেতর থেকে একটা দুমড়ানো পাঁচ টাকার নোট, আর একটা বিশ টাকার নোট বের হল। আমার দিকে তাকিয়ে কাচুমাচু করে মেয়েটা জিজ্ঞেস করলো, “পাঁচ টাকায় হইবোনা?”
আমি উত্তর দিলাম, না হবে না।আমার তিরিশ টাকার বাদাম লাগবে। খিদা পেয়েছে অনেক।
আমার কাছে তো পঁচিশ টেকা আছে খালি… মেয়েটা ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলো।
আমি কিচ্ছুক্ষন নীরব হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর নিজেই জিজ্ঞেস করলাম, বাদাম খাবি ?
মেয়েটা হা করে তাকিয়ে রয়েছে। হয়তো ভাবছে কোন পাগলের খপ্পরে পড়লাম। একবার বলে বাদাম খাওয়াবি, আরেক বার বলে বাদাম খাবি ? লোকটা কি সত্যি পাগল না কি ?
আমি উঠে গিয়ে বাদাম ওয়ালাকে ডাক দিলাম। গুনে গুনে ৫০ টাকার বাদাম নিলাম। বাদাম কেনা শেষ করে পিছনে তাকিয়ে দেখি মেয়েটা নেই।
চুপচাপ বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। একটা একটা করে বাদাম ছিলছি আর মুখে ঢুকাচ্ছি আর ভাবছি মেয়েটা একটু পরেই ফেরত আসবে। তার ফুলগুলো এখনো আমার হাতে। এগুলো ছাড়া সে বাঁচতে পারবে না। বেঁচে থাকার জন্য তার এই ফুলগুলো দরকার। ফুলগুলো ছাড়া তার জীবন অসম্পূর্ণ।
মেয়েটাকে আমি পেয়েছি ঠিক একঘন্টা আগে।রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিছিলাম। হঠাৎ দেখি গুন্ডার মতো একটা ছেলে টং দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে রীতিমত মেয়েটাকে শাসাচ্ছে। পাশে তার ছেলে বন্ধুগুলো সিগারেট টানছে আর মজা নিচ্ছে।কাছে গিয়ে শুনলাম মেয়েটাকে ছেলেটা বলছে,
––ফাইজলামি করো ? ধান্দাবাজি করস আমাদের এলাকায় এসে ? এক একটা ফুল ডাবল দামে বেচস ? পাঁচ টাকার ফুল পনেরো টাকা চাস ? সাহস তো কম না তোর।
কাছে গিয়ে বললাম কিরে ভাই ? সমস্যা কোনো ? আমার বোনকে কি বলেন ? কিরে বকুল, কি হইছে তোর ? উনারা এসব কি বলছে তোকে?
কথার ধাঁচ শুনে এমন গুন্ডার সাইজ ছেলেগুলোও কেমন জানি হতভম্ব হয়ে গেল। আমি কিছু না বলে হাত ধরে ওখান থেকে মেয়েটাকে নিয়ে চলে আসলাম।
এরপর থেকেই মেয়েটা আমার সাথে ঘুরছে।যেখানেই যাচ্ছি ওকে সাথে করে নিয়ে যাচ্ছি।মেয়েটা ভয় পেয়েছে প্রচুর। আর আমাকেও ভয় পাচ্ছে। অবশ্য ভয় পাবারই কথা। কত আর হবে বয়স, নয় কি দশ ? এতটুকু একটা বাচ্চা মেয়ে কি বা বুঝে।আমি তাকে গুন্ডাগুলোর হাত থেকে উদ্ধার করেছি বলে আমাকে ছেড়ে যেতেও পারছে না। ভয়ে ভয়ে আমার পিছন পিছন ঘুরছে।
প্রায় মিনিট দশেক পর মেয়েটা ফেরত আসলো। সাথে তার থেকেও পিচ্চি একটা ছেলে। সাহস জোগাতে এনেছে সম্ভবত। ছেলেটাও ভয় পাচ্ছে।কাচুমাচু হয়ে মেয়েটার পিছনে দাঁড়াল।
মেয়েটা ভয়ে ভয়ে বললো, ভাই আমার ফুলগুলো দিবেন না ?
আমি বললাম, ফুলগুলো আমি কিনব, কত নিবি ?
ফুল নেয়ার কথায় মেয়েটার চোখ চিকচিক করতে লাগলো। খুশিতে আনন্দিত হয়ে বলল স্যার– আপনি সত্যি নিবেন ? অমঅর সোনঅ
––১০ টেকা পিচ স্যার
––এক্ষুনি তো ভাই ডাক ছিলি।এখুনি আবার স্যার হয়ে গেলাম ?
––অভ্যাস হইয়া গেছে ।
––ওই সময় কত য়েছিলি? গুন্ডা গুলোর কাছে?
––১৫ টেকা।
––৫টাকা বেশি চেয়েছিলি কেন?
––সারাদিন ফুল বিক্রি হয় নাই। টেকা না দিলে খালায় বকব। সারাদিন না খায়া থাকতে হইব তাই একটু বাড়ায় কইছিলাম।
আমি পকেট থেকে কয়েকটা ১০০ টাকার নোট বের করলাম।চার ‘শো টাকা দিয়ে বিশটা ফুল কিনে বললাম,কখনো কাউকে ঠকাবিনা।দরকার হলে না খেয়ে থাকবি।তবুও কারো কাছে বেশি টাকা নিবি না।
সাথে সাথে ২০০ টাকা আমাকে হাতে ধরিয়ে বলল–আচ্ছা তাইলে এই টেকাডা রাহেন আমি আপনার থাইক্যা বেশি নিবার পারুম না। আরে পাগলী বেশি না আমি ২০ টাকা পিচ হিসেবে ফুল নিয়েছি তাই বিশ টা ফুলের দাম চারশো টাকা হইছে। তুই পুরা টাকা টাই রাখ… একটু ধমকের সুরেই বললাম, বলে ওর হাতে টাকাটা ফেরত দিলাম।
পাশে পিচ্চি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে ইশারা করে বললাম, কে হয় তোর ?
–ছোডো ভাই আমার।
একটা ১০০ টাকার নোট বের করে পিচ্চিটাকে দিলাম।দিয়ে বললাম কিছু ফলমূল কিনে নিস। পিচ্চিটা খুব খুশি হয়ে গেল।দুজন দৌঁড়ে এসে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল… কাছে ডেকে বললাম–
আমি : দুজনে থাকিস কোথায় ? বাড়িতে আর কে কে আছে ?
বকুল : ওই যে ওই হানের রাস্তা দিয়া যাইতেই একটা বস্তি আছে ওইহানে থাকি। মা, আমি আর ছোডো ভাইডা মিলা এক লগে থাকি।
আমি : তুই পড়ালেখা না করে এই বয়সে রাস্তায় কেন এসেছিস ? তোর বাবা–মা কি করে?
বকুল : মায় তো অসুস্থ।আগে মাইনষের বাড়িত কাম করতো এহন আর শরীলে কুলায় না… মাইনষেও আর কাম দিবার চায় না অসুস্থ বইলা। আমি রাস্তায় ফুল না বেঁচলে মা আর ছোডো ভাইডা রে দেখব কেডায়, খামু কি আমরা ? আমাগো দেখবার মতো কেউ নাইকা।নিজে কাম না করলে আমাগো না খায়া মইরা যাওন লাগব।
আমি : তোর বাবা কোথায় ? তিনি তোদের সাথে থাকেন না ?
বকুল : কি যে কন না স্যার… বুদ্ধি হওনের পর থাইক্যা বাপ রে কোন দিন কাছে পাই নাই… মায়ের কাছে হুনছি বাপে আগে শহরে গিয়া কাম কইরা টেকা পাঠাইতো আমাগো,বাড়িত আইতো না বেশি… তহন আমি ছোডো আছিলাম, দেখলেও ভাল কইরা চেহারা মনে করবার পারি না। আর ছোডো ভাই হওনের পর তো আমাগো একবারে ছাইড়া চইলা গ্যাছে। এরপর থাইক্যা মায় কাম কইরা সংসার চালাইতো। এহন অসুখের লাইগ্যা আর কামে যায় না। জানেন স্যার যে টেকা ডি পাই তা দিয়া আমাগো ৩ বেলা খাওন-দাওন আর মায়ের ওষুধ কিনতেই শ্যাষ হইয়া যায়।ভাইডার লাইগ্যা অন্য কিছু কিনবার পারি না।
আমি চুপচাপ বকুলের কথাগুলা শুনছিলাম আর ভাবছিলাম- এইটুকু ছোট ছোট বাচ্চা ছেলেমেয়ে যাদের এই বয়সে এখন স্কুলে যাওয়ার কথা তারাই কি না সংসার চালানোর জন্য রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে।মায়ের চিকিৎসার জন্য খরচ বহন করতে হচ্ছে এই ছোট্ট মেয়েটাকে।ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস ! ভাগ্যই আজ বকুলকে রাস্তায় নামিয়ে এনেছে।ওর বাবা সাথে থাকলে হয়তো ওকে এতটা কষ্ট সহ্য করতে হত না , মানুষের হাতে পায়ে ধরে ফুল বিক্রি করতে হত না, এতটা লাঞ্ছনা-গঞ্জনা আর অবহেলা সহ্য করতে হত না। মানুষের জীবন কত বিচিত্রময়। এই শহরে নানা মানুষের বাস… কাউকে খুব কাছ থেকে না দেখলে তাদের জীবন-যাপন সম্পর্কে জানা যায় না, তাদের দুঃখ-কষ্ট,
অভাব-অনটন কি জিনিস তা বুঝা যায় না।
খানিকক্ষণ বাদেই বকুল বলে উঠল- স্যার এতো কি ভাবতেছেন ? বাড়ি যাবেন না, সন্ধ্যা হইয়া যাইতেছে তো। আমি কি বলে যে বকুলকে সান্ত্বনা দিব তার ভাষা খুঁজে পেলাম না। শুধু বললাম, হুম যাব।
আমি : আচ্ছা বকুল তুই কি প্রতিদিন এখানে আসিস ফুল নিয়ে ?
বকুল : হ আসি… তয় ওই রেললাইনের ধারে বেশি যাই, ওইহানে ফুল বেশি বেঁচবার পারি। এইহানে মাঝে মইধ্যে আসি।
আমি : কতক্ষণ থাকিস আর কত টাকা পাস ? রাতে ও কি ফুল বেচিস ?
বকুল : ঠিক নাই , যেদিন যেমন বেঁচতে পারি। রাইত ৮ টা পর্যন্ত থাকন লাগে না হইলে খালায় বকে আর বেশি টেকা দেয় না। তয় আজকে আর থাকমু না আপনি যে টেকা দিছেন এইডা আমার ২ দিনের ইনকাম।
আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেলাম না… আকাশের দিকে নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ আর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম।
বকুল : আইচ্ছা স্যার আমরা এহন বাড়ি যাই , মায় একা রইছে। আপনার লগে অনেকক্ষণ কথা কইলাম আবার অন্য একদিন দেখা হইলে কথা কওন যাইবো।স্যার আপনি অনেক ভালা মানুষ.. আল্লাহ আপনের ভালো করব।
আমি উঠে দাঁড়ালাম… সামনে একটা দোকান দেখতে পেয়ে ওদের দুজনকে সাথে করে নিয়ে কিছু খাবার কিনে বকুলের হাতে দিয়ে বললাম- এখন দুজন বাসায় যা, মা আর ভাইকে নিয়ে খাবার গুলো খেয়ে নিস কেমন। দুজন বেশ খুশি হয়ে গেলো, বকুলের মুখে এক চিলতে হাসি ফুঁটে উঠল। ওদের হাসিমাখা মুখটা দেখে নিজের অজান্তেই চোখের কোণে এক ফোঁটা পানি চলে আসল।
ততক্ষণে সন্ধ্যা প্রায় মাগরিবের আযান শুরু হবে।খাবারগুলো হাতে দিয়ে ওদেরকে বিদায় জানিয়ে আমি আমার গন্তব্যের দিকে রওনা হলাম। একা একা রাস্তায় হাঁটছি আর একমনে ভেবে চলেছি মানুষ কতটা অসহায়, কতটা লড়াই করে বেঁচে থাকে এক একটা মানুষ, এক একটা পরিবার। আহা জীবন আহারে জীবন !
আরো জীবনের গল্প পড়ুন এখানে Jiboner golpo