আমার নাম রাহেল, আমি ঢাকায় থাকি। ঋতিকা সাথে আমার পরিচয়টা কিভাবে হয়েছিল তা আমি প্রায় ভুলেই গেছি, আমি যখন ক্লাস সিক্স এ পড়ি তখন ঋতিকা ও তার পরিবার আমাদের পাড়ায় আসে, ওদের দেশের বাড়ি রাজশাহীতে, এখানে ওর বাবা একটা চাকুরী নিয়ে এসেছিলো। আমি ঋতিকাকে প্রথম দেখেছিলাম আমার ক্লাস রুমে, ও আমার পাশেই বসেছিল কিন্তু আমরা একবারের জন্যও একে অন্যের সাথে কথা বলেছিলাম না, কারণ টা জানি না। তবে অনেক দিন পর উপলব্ধি করলাম আমি আর ঋতিকা অনেক ভালো ফ্রেন্ড হয়ে গেছি, কিন্তু কিভাবে তাও জানিনা। যখন ক্লাস নাইন এ পড়ি তখন একদিন হঠাৎ করেই ভাবতেছিলাম, ঋতিকা এখন আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। স্কুল এ আমরা অনেক আড্ডা দিতাম, আবার কোথাও ঘুরতে গেলেও আমার ঋতিকাকে পশে চাই।কারণে অকারণে আমি ঋতিকাকে খুঁজতে ওর বাসায় যেতাম,
আঙ্কেল আন্টি ও আমাকে অনেক ভালোবাসতো। আমি ঋতিকাকে অনেক বোকা বানাতাম আর ও বোকা হয়ে আমার দিকে ফেল ফেল করে তাকিয়ে থাকতো। ওকে দেখলেই আমার অনেক মায়া লাগতো কিন্তু তও কেন জানি আমি ওর সাথে অনেক দুস্টুমি ফাজলামি করতাম। ফাজলামি করতে গিয়ে একবারতো কাঁচি দিয়ে আমি ওর চুল ই কেটে দিছিলাম। ঋতিকা এইজন্য সারা দিন কান্না করেছিল, আর আমার সাথে চার দিন কথা বলেছিলোনা। আমিও অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম, কিন্তু সরি বলার জন্য যখন চারদিন পর আমি ওর সামনে দারালাম তখন আমি কিছু বলার আগেই ওই আমাকে সরি বললো আর কারণ জানতে চাইলে বললো ও চারদিন আমার সাথে কথা বলেনি এইজন্য। আমি আশ্চর্য হয়ে ঋতিকার দিকে তাকিয়ে ছিলাম আর ভাবছিলাম এই জন্যই ওকে আমার এত ভালো লাগে। আমরা একই সাথে বোরো হলাম। সময়ের আর সাথে সাথে অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়ে গেছে, আগে আমরা স্কুল এ পড়তাম আর এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। আমাদের পছন্দ অপছন্দ, ভালোলাগা মন্দলাগা এইগুলো ও কিছু তা পরিবর্তন হয়ে গেছে, ঋতিকা আগের থেকেও এখন আরো বেশি সুন্দরী হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের ফ্রেন্ডশিপ এখনো অপরিবর্তিতই আছে, আমি আর ঋতিকা এখনো একসাথে ভার্সিটি যাই, ঘুরতে যাই, বাহিরে খেতে যাই, আড্ডা দেই , মারামারি করি, রাগারাগি করি, আবার খুব বেশিক্ষন অভিমান করে থাকতেও পারি না। ইউনিভার্সিটিতেও আমাদের অনেক দিন কেটেগেলো, ঋতিকা পড়াশোনা নিয়ে অনেক সিরিয়াস ছিল, কিন্তু আমি পড়াশোনা নিয়ে অতটা ভাবতামনা। ও আমাকে সবসময়ই বলতো অনেক ভালো করে পড়াশোনা করতে, যাতে পড়ালেখা শেষ করে ভালো একটা চাকুরী পাই। আমি ওকে বলতাম আমি ভালো চাকুরী পাইলে তোর কি? তোকেতো আর কিছু দিবোনা, ও চুপ করে থাকতো কিছুই বলতোনা। কিন্তু ভাবনায় পড়েগেলাম সেইদিন, যেদিন ঋতিকা আমার এই একই কথা শুনে চুপ করে তো থাকলোনা বরং হাঃহাঃহাঃ করে হাসছিলো আর বললো, আমাকে কিছু দিতে হবেনা তুই পেলেই আমারও হবে। যদিও বিষয়টা ভাববার মতো তেমন কিছুই না তাও ভাবছি। কারণ বেশকিছু দিন ধরে লক্ষ্য করছি ঋতিকা আমাকে কিছু কিছু কথা বলছে যা আগে কখনো বলেনি, আর কিছু কিছু আচরণের কোনো মানেই খুঁজে পাতছিলামনা। এই কিছুদিন আগে ভার্সিটিতে একটা মেয়ে দেখে আমার পছন্দ হয়েগেলো, আর ঋতিকা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড তাই স্বাভাবিক ভাবেই আমি ওকে একথাটা জানালাম।
কিন্তু ঋতিকা এইটা শুনে এমন বাজে ভাবে রিয়েক্ট করলো যেন আমি মহা একটা পাপ করে ফেলেছি, আমি যেন ওকে ছাড়া আর অন্য কেন মেয়েকে পছন্দ তো করতেই পারবোনা কেন মেয়ের দিকে তাকাতেও পারবোনা। আবার একদিন পূর্ণিমা রাতে ছাদে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখছিলাম কোথাথেকে জানি ঋতিকাও এসে আমার পশে দাঁড়ালো, যদিও এর আগেও আমরা রাতে একসাথে চাঁদ দেখছি কিন্তু সেদিন আচম্কা ঋতিকা আমার কাঁধে হাতদিয়ে কানে কানে ফিস ফিস করে বলছিলো রাহেল আমরা যদি সারা জীবন এইভাবে পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে পারতাম? উত্তরে আমি কিছুই বলিনি, শুধু কাঁধ থেকে ওর হাতটা নামিয়ে দিয়েছিলাম। রাতে শুয়ে শুয়ে এইসব কথা গুলোই ভাবছিলাম। কিছুদিন যাবৎ দেখছি ঋতিকার চোখমুখ অকঁ শুখিয়ে গেছে, ও কোনো কিছু নিয়ে অনেক টেনশন করছে মনেহয় আবার সবসময় মন ও খারাপ থাকছে। কেনো? ঋতিকাকে জিজ্ঞাস ও করেছিলাম কিন্তু কিছু বলেনি। ঋতিকার মন খারাপ এইটা দেখতে আমরা ভালো লাগছেনা, ও তো কিছুই বল্লোনা তাই ঋতিকার মন খারাপের কারণ জানার জন্য আমি আন্টিকে ফোন দেই, জানতে পারি যে বাসা থেকে ওর বিয়ের কথা চলছে আর ও এখন বিয়ে করতে চায়না। আর এটাই ছিল ঋতিকার চিন্তা ও মন খারাপের কারণ। তারপর আমি যখন ঋতিকাকে বললাম, আমি জানি তোর মন খারাপের কারণ কি? তখন ওর চোখে আনন্দ দেখতে পেলাম, সাথে সাথেই ও আমাকে জিজ্ঞাস করলো তুই কি সত্যি জানতে পারছিস আমার মনখারাপের কারণ কি? হুম জানি তো বাড়ি থেকে টুকে বিয়ে দিতে চাইছে কিন্তু তুই এখন বিয়ে করবিনা এইজন্যই তো তোর মন খারাপ তাইনা? আমার কথা শুনে ঋতিকা আমার দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকলো, মনে হলো ও একটু হতাশ হলো। আমি অনেক কোথায় বললাম কিন্তু ও কিছুই বললো না। কিছুক্ষন পর হঠাৎ ঋতিকা আমার ওপর অনেক রেগে গেলো, আস্তে আস্তে আমার পিঠে কয়েকটা মারলো আর কিসব বলছিলো। আমি নাকি ওকে একটুও বুঝিনা, ও এতো বার করে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে কিন্তু আমি কেন কিছু বুঝতে পারছিনা? এইসব আরো অনেক কিছু। আমি সত্যি কিছু বুঝতে পারছিলাম না। ঋতিকাকে একটু শান্ত করে জানতে চাইলাম ও আমাকে কি বোঝানোর চেষ্টা করছে আর আমি কি বুঝতে পারছিনা? তখন সে কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো তারপর খুব সহজেই বলেদিলো, রাহাত আমি তোকে অনেক ভালোবাসি, আমি তোকে ছাড়া জীবন কাটাতে পারবোনা, আর এই সহজ কথাটা তুই কেন বুঝতে চাইছিস না? কিন্তু সত্যি আমি এই কথা গুলো সোনার জন্য একটুও প্রস্তুত ছিলামনা। রিতিকা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, তাই ওর সবকিছুই আমি জানি, ওকে আমার ভালোই লাগে,কিন্তু কখনো এইভাবে চিন্তা করিনি। ঋতিকাকে কি বলবো কিছুই বুঝতে পারছিনা। আমি ওকে একা রেখেই চলে আসলাম, বুঝতে পারছিলাম যে ও অনেক কান্না করতেছিলো কিন্তু কিসেরজানী একটা ভয়ে আর ওর পশে যেতে পারিনি। রাতে আমি ঋতিকার কথা অনেক ভাবলাম, অনেক রকম ভাবে ভাবলাম, আর বুঝলাম আমিও ঋতিকাকে অনেক ভালোবাসি। ঋতিকাকে ছাড়া আমার কিছুই ভালো লাগতোনা, ওর মন খারাপ থাকলে আমারও মন খাড়াও হয়ে যেত। আর ঋতিকার সাথে আমি সারাজীবন কাটবো এইটা ভাবতেই ভালো লাগছে। আমি আসলেই অনেক বোকা শুধু শুধু ঋতিকাকে কত কষ্টইনা দিলাম। এইসমস্ত অনেক কিছু ভাবার পর যখন আমি একদম সিওর হলাম যে আমি সত্যি সত্যি ঋতিকাকে ভালোবাসি, তখন আর একটুও সময় নষ্ট নাকরে সাথে সাথে আমি ঋতিকাকে ফোন করলাম। ওর কণ্ঠস্বর শুনে বুঝলাম ও অনেক কান্না করেছে আর অনেক কষ্টও পেয়েছে। কিন্তু আমার কথা শুনে ও আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলো, খুশিতে আবারো কান্না করেদিল। আমাদের এত দিনের বন্ধুত্ব আজ ভালোবাসা হয়ে গেলো। এতো ভালো লাগছিলো যে মনেহটছিলো আমরা এখনই দেখা করি। কিন্তু রিতিকা আমাকে অবাক করে বললো আমাদের নাকি দুদিন পর দেখা হবে। কারণ ওর বড়আম্মু অনেক অসুস্থ তাই কাল ভোরের বসেই রাজশাহী চোলে যাচ্ছে আর দুইদিন পর ঢাকায় ফিরবে, তাই আমাদের দুদিন দেখা হবে না। কালকে আমাদের দেখা হবেনা এইটা আমি কিছুতেই মেনেনিতে পারছিনা, তাই ওকে অনেক জোর করছি রাজশাহী তে নাযায়র জন্য। কিন্তু ঋতিকা আমাকে বোঝাছছিলো মাত্র দুদিনেরই তো বেপার ও ফিরেআসলেই দেখাকবে।
— ঠিকাছে অনেক রাত হলো এখন ঘুমিয়ে পর, আমাকে আবার কাল ভোরেই যেতে হবে।
–ওকে, সাবধানে যাস, ভালোথাকবি, টাটা!
–তুই টেনশন করিসনা! আমি এত সহজে মরবোনা। তুইও ভালোথাকবি, আল্লাহ্হাফেজ!
আর এটি ছিল তার শেষ কথা। পরদিন সকাল দশটার দিকে খবর আসে ওদের বাসটা এক্সসিডেন্ট করে, আর ওই এক্সসিডেন্ট এ ঋতিকা আর ওর মা সোহো আরো তিনজন মারাগেছে।