সবে মাত্র ভার্সিটি এডমিশন পরিক্ষা দিয়েছি, ভর্তি যুদ্ধের জন্য একটানা পড়া-লেখা করে বেশ হাপিয়ে উঠেছিলাম। ক্লাস শুরু হতে কিছু দিন দেরি আছে সেই সুজুগে ব্যাগ গুছিয়ে চলে গেলাম সিলেট। বড় খালামনির বাসায়। রাতুল ও রাহিন আমার কাজিন। রাতুল আমার সমবয়সী আর রাহিন দেড় বছরের ছোট। কাজিন ২ টা থাকায় বেশ হৈ হুল্লোড় করে ৫-৭ দিন কাটিয়ে দিলাম। সিলেট শহর টা বেশ গুছানো ,ছিমছাম পরিবেশ। এখানে প্রায় ই বৃষ্টি হয়। সবাই মিলে বৃষ্টি খুব উপভোগ করি। এই কয়েকদিনে প্রচুর মজা করলাম। সিলেট শহর ঘুরে বেড়ালাম। হযরত শাহজালাল এর মাজার শরীফ ,সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, জাফলং, বিছনাকান্দি ও চা বাগান সহ আরও বেশ কয়েকটি জায়গা ঘুরে বেড়ালাম। আমাদের সাথে রাতুলের ২ টা বন্ধু ও ছিল, ওদের সাথে আমার বেশ ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গেলো।
প্রতিদিন বিকেলবেলা মাঠে গিয়ে ক্রিকেট খেলা ,সন্ধ্যার পরে চায়ের দোকানে আড্ডা দেওয়া ,সারাদিন একসাথে ঘুরে বেড়ানো এগুলা নিয়েই মেতে ছিলাম ১০ দিনের মতো। আর এই ১০ দিন অনেক ঘুরেছি,নতুন বন্ধু পেয়েছি ,সত্যি কথা বলতে সিলেটের প্রেমে পরে গেছি। খুব মিস করব এই ছোট্ট শহরটা কে। কিভাবে ১০ টা দিন কেটে গেল টের ই পেলাম না । এবার ঢাকায় ফেরার পালা………
আমি চলে আসব বলে আগে থেকেই রাতুল ট্রেনের টিকেট কেটে রেখেছিলো পরে যাতে সমস্যায় না পড়ি। রাতের ট্রেন, তাই বাসা থেকে আম্মু টেনশন করছে ,বার বার ফোন করছে সাবধানে আসার জন্য। রাতের খাবার খেয়ে খালামনির কাছে বিদায় নিয়ে রওনা হলাম। রাতুল ও রাহিন স্টেশন পর্যন্ত এসে আমাকে এগিয়ে দিলো। কিছুক্ষন বসে থাকার পর যথাসময়ে সিলেট স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়লো, রাত তখন ৮ টা।
এটাই আমার প্রথম ট্রেন জার্নি। জানালার পাশের সিট টা আমার,হালকা মৃদু বাতাস এসে গায়ে লাগছে। নিরিবিলি-নিস্তব্ধ চারপাশ,অন্ধকারে মাঝে মাঝে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে আর শো শো শব্দ করে ট্রেন ছুটে চলেছে তার আপন গতিতে। বেশ উপভোগ করছি। শুনেছি সিলেট থেকে ঢাকা আসতে ৪-৫ ঘন্টা সময় লাগে। সেই হিসেবে ১ টার মধ্যে রেলস্টেশন এ পৌঁছানোর কথা। একা একা বসে এসব ই ভাবছিলাম আর হেডফোনে গান শুনছিলাম । হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল টিটির ডাকে।
—টিকিট প্লিজ !
—মানে সামনে এয়ারপোর্ট স্টেশন ??? হ্যাঁ।
কখন যে ঘুমিয়ে গেছিলাম বুঝতেই পারিনি। ঘড়িতে তাকালাম রাত ১:০০ বাজে। তার মানে সিলেট থেকে আসতে ৫ ঘণ্টা লাগলো।
নেমে পড়লাম ট্রেন থেকে। আমার সাথে সাধু গোছের ৮/১০ জন নামলো। তারাও সিলেট থেকে এসেছে। দেখে মনে হয় হযরত শাহজালাল এর মাজারে গেছিলো। তাদের জিজ্ঞাস করলাম কোথায় যাবেন ? শুনেও তারা না শোনার ভান করে ২ টা ভ্যান রিজার্ভ করে চলে গেল। খুব রাগ হল তখন। আশেপাশে কেউ নেই, চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। সচারাচর এই রাস্তা তেমন একটা ফাঁকা ও নির্জন থাকে না…আজকেই কেন জানি না পুরা রাস্তা ফাঁকা আর চারদিকের দোকানপাঠ সব বন্ধ। বাসায় যাব কিভাবে ভাবতে ভাবতে সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। এই রাস্তটা আমার বেশ পরিচিত তাই নির্ভয়ে পথ চলছিলাম। কিছুদূর সামনে আসতেই একটা চায়ের টং দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
স্টেশন মাস্টার একটা চায়ের দোকানদার আর আমি ছাড়া জাগ্রত কোন ব্যাক্তি নেই সেখানে……
একটা গাড়িও পেলাম নাহ । এই দিকে গন্তব্য প্রায় ২ ঘন্টার পথ। কি করবো কিছু বুঝে উঠতে না পেরে চায়ের দোকান থেকে একটা সিগারেট নিয়ে টানছি আর স্টেশন দিয়ে হাঁটছি। বুঝতে পারছিনা কি করবো।
হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ ছাড়িয়ে এলাম। সিগারেটও শেষ। এমন সময় ভ্যানের ক্রিংক্রিং আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি তো পুরাই অবাক। রাত তখন ১ টা বেজে ৪৫ মিনিট। ভাবলাম আমার মতোই কেউ বাসায় যাচ্ছে,হয়ত কোথাও ঘুরতে গিয়েছিলো। আচ্ছা আমি যদি ওদের সাথে যাই। তবে কেমন হয় ! কথাটা মনে করতেই ভ্যানওয়ালাকে বললাম দাঁড়াও।
ভ্যানটা সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেল। কি আশ্চর্য ভ্যানে আর কেউ-ই নেই। অথচ আমার মনে হল ভ্যানে ২-৩ জন লোক বসা ।
–ভাইজান কোনটি যাইবেন??
–গোলাপ নগর। যাবা??
–হ যাইব তয় ভাড়া কিন্তু বেশী দেওন লাগবো।
–আরে যা লাগে দিব। আগে চলো তো ভাই !
যাক বাবা একটু আরাম পেলাম। ভ্যান তো পেয়েছি যতক্ষন লাগে লাগুক হাঁটতে তো আর হবে না। মনে মনে খুব শান্তি লাগছে। কিন্তু তখনো আমি জানিনা আমার সাথে ঠিক কি ঘটতে চলেছে।
আমি একটু পর একটা সিগারেট জ্বালাতেই ভ্যানওয়ালা পিছন ঘুরে বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল……
–ভাইজান সিগারেট খাইয়েন নাহ !
–কেন ??
–সমস্যা আছে।
ছোটবেলা থেকেই আমি আবার একগুঁয়েমি স্বভাবী। আঁড়চোখে বললাম যে তোমার লাগলে বল একটা দেই। সিগারেট আমি ফেলবোনা।
এবার যা দেখলাম তা দেখার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম নাহ ! সিগারেট জ্বালানোর জন্য আগুন জ্বালাতে, হঠাৎ করেই লোকটা ভ্যানিস হয়ে গেল। কি বলবো আমি কিছু বুঝে উঠতেই পাড়ছিলাম নাহ।কেমন জানি একটা বোটকা গন্ধে চারিদিক ভরে গেল। সামনে আমি ছাড়া অন্য কোন লোক তো দূরে থাক সামান্য আলোও দেখছিলাম নাহ। চারদিক পুরা অন্ধকারে আচ্ছন্ন।
এবার যা দেখলাম তাতে আমার শরীর ঠান্ডা বরফের মত জমে গেল। একটা গরুর মত প্রাণী আমার দিকে ধেয়ে আসছে। মাথা নেই, শিং নেই। চোঁখ দুটো অস্বাভাবিক বড়। একদৌঁড়ে ঠিক যেন আমার বুকের উপর এসে উঠবে । কি করব কিছুই মাথায় আসছেনা। দোয়া-কালেমা যত যা জানি সব ভুলে গেলাম মুহূর্তেই, মনে হচ্ছিল কিছুই আমি জানিনা। আজ আমি শেষ। আমার আর বাঁচার কোন রাস্তা নাই,আজ ই হয়তো আমার শেষ দিন। খুব জোরে দৌঁড় দিতে ইচ্ছা হলেও, শত চেষ্টা করে ও পারলাম নাহ। মনে হচ্ছিল পা দুটো মাটির সাথে লেগে গেছে, যেন কেউ আমাকে শক্ত করে ধরে আছে । অনেক চেষ্টা করেও যেন ছাড়াতে পারছি না। ভয়ে আমি ঘামছি তো ঘামছিই।
পরক্ষনে আবার আমার সামনে আসতেই তার রুপ পরিবর্তন করলো। কি সে এক ভয়ংকর বিশ্রী রুপ। সাদা ধবধবে পোশাক পড়া লম্বা আকৃতির দেহ, পা দুটো শূন্যে ভাসছে,লম্বা ২ টা দাঁত বের করা মুখ, চোখ দুটো জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। ভাবলেই আজো গায়ে কাটা দিয়ে উঠে। এত কিছু আমি আর সহ্য করতে পারলাম নাহ। যতক্ষণ হাতে সিগারেট ছিল, ততক্ষন দাঁড়িয়েই ছিলাম । কিনসিটু সিগারেট শেষ হওয়ার পর কি হয়েছে আমার জানা নেই।
সকালে জাগা পেয়ে দেখি আমি বাসায় আমার রুমে শুয়ে আছি। পরে জানতে পারলাম একদল লোক রাস্তায় আমাকে অচেতন অবস্তায় পেয়ে বাসায় পৌঁছে দিয়েছে।
তারপর থেকে কিছু দিন আমি একা একা কোথাও বেড়াতে যাই নি। এমনকি বেশি রাতব্দি বাহিরে কাটেনি । তার কিছুদিন পরে রাতে সিগারেট খেতে গেটের বাহিরে গিয়েছিলাম । সিগারেট জ্বালাতে একটা বোটকা গন্ধ, হঠাৎ আমার সেই রাতের কথা মনে পরে গেলো, আমি দৌড়ে বাসার ভিতরে চলেগেলাম । খুব সকালে লোক জনের চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙলো , বাহিরে বের হয়ে দেখি আমাদের পাশের বাড়িতে কুরবানীর জন্য কিনে আনা গরুটা খুব ভযঙ্কর ভাবে মারা গেছে । আমার বুঝতে বাকি রইলো না কি হয়েছিল । এই ঘটনাটা হয়তো আমার সাথে ঘটতো । এখন আমি আর বেশি রাতে বাহিরে যাইনা । সিগারেট টাও বেলকনিতে খাওয়া শুরু করেছি, বাড্ডেয়ার ইচ্ছা ছিল কিন্তু বন্ধুদের সাথে মিস্টি গিয়ে আর ব্যাড দেয়া হয়ে ওঠেনি । সেই রাতের ভয়ংকর দৃশ্য মাঝে মাঝে এখনো চোখের সামনে ভেসে উঠে , ভয়ে সারা শরীর আঁতকে উঠে আমার ……
For more Vuter Golpo