শেষ বার যখন এসেছিলাম হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলাকে খুজতে কিছুই আর আগের মত পায়নি শুধু গ্রামের এই স্কুলটা ছাড়া | উন্নয়নের ধারা গ্রামের মধ্যে বয়ে গেলেও ও স্কুলটা যেন কারো চোখে পরেনি তাই হয়তো আগের মতই রয়ে গেছে | এই স্কুলটার কথা আমি আজ ও ভুলতে পারিনা, যেখানে আমার লেখাপড়ার হাতে খরি হয়েছে সেই স্কুলটার কথা এতো সহজে কিভাবে ভুলে যাব, হয়ত এটা ভেবেই মনের মধ্যে আগলে রেখেছি |
স্কুলের প্রতিটা দেয়ালের প্রতিটা ইট আমাকে আমার ছেলে বেলা মনে করিয়ে দেয়, আর মনে করিয়ে দেয় জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া একজন বিশেষ মানুষের কথা | যার জন্য এই নিস্প্রান স্কুলের দেখাশুনার দায়ভার আজ আমার কাধে |
তখন আমি ক্লাস ৪ এ পরি | এই গ্রামে নতুন ভাবে বসবাস শুরু করেছি | এখান থেকে প্রায় ৩৪ কিলোমিটার দুরে আমার নিজের গ্রাম, যেখানে আমার জন্ম হয় | পরিবারের সদস্য হিসেবে আমি আর বাবা মা | আমার বাবা ছিলেন গ্রামের সামান্য কৃষক, কিন্তু কৃষক হলেও আমাদের দিন গুলো ভালই যাচ্ছিলো | প্রকৃতির দরুন প্রভাবে একদিন সব কিছু হারিয়ে নিজের গ্রাম ছেড়ে পরিবার সহ এই গ্রামে চলে আসি | অনেক কষ্ঠ হলে ও বাবা মার অপার চেষ্টা আর আল্লাহর অসীম কৃপায় আমার আবার আগের মত সচল হয়ে ছিলাম | সেদিন বাবা বলেছিল বুঝতে পারলিরে মা , মানুষ চেষ্টা করলে সব পারে | সেদিনের বাবার সেই কথাটা আজ ও আমার কানে বাজে |
নতুন স্কুলে ভর্তি হওয়ার কারণে কেউ আমার সাথে কথা বলত না | আমি একা একা স্কুলে আসতাম , একা এক ব্রেঁচে বসতাম আর স্কুল শেষে একাই বাড়ি যেতাম | কিন্তু সেদিন আমি একা বাড়ি যেতে পারিনি আমার সেই বিশেষ মানুষটির জন্য | দিনটি ছিল সোমবার বিকেল , স্কুলে পরা না হওয়ায় আমাকে বাদ দিয়ে স্যার সবাই কে মেরেছিল | স্কুল শেষে যখন বাড়ি দিকে রওনা হলাম দেখলাম পেছন থেকে কেযেন ডাকছে রাহা এই রাহা দারা আমি ও যাব তোর সাথে | আমার নাম রোহিনী , রাহা নয় তাই তার ডাকে সারা না দিয়ে বাড়ির দিকে ছুটছিলাম হঠাত কবির সামনে এসে বলল কিরে কখোন থেকে ডাকছি একটু দারা | হা আমার সেই বিশেষ মানুষটির নাম কবির |
রাহা: আমার নাম রাহা নয় রোহিনী তাই তোর ডাকে সারা দেয়নি
কবির: সে যাই হোক একবার দাড়াতে পারতি দেখসিস তো আসে পাসে আর কেও নাই |
রাহা: হুম | কি বলবি বল|
কবির: কিছুনা, চল একসাথে বাড়ি যাই |
যেতে যেতে কবিরের সাথে আমার অনেক কথা হয় | আমরা একে ওপরের পরিবার সম্পর্কে জানতে পারি | সেদিনই কবিরের সাথে আমার প্রথম পরিচয় | ভাগ্গিস ক্লাসে আজকে শুধু আমার পরা হয়েছিল তাই একজন বন্ধু পেলাম | সেদিন এর পর থেকে আমার ২ জন কেও একা বাড়ি ফিরিনি, একা স্কুলে আসিনি | যা কিছু করেছি ২ জন একসাথে | কবির অনেক দুষ্ট ছিল | আমার মনে পরে একবার আমি আর কবির তার চাচার পুকুরে চুরি করে মাছ মারতে গিয়ে ধরা পরেছিলাম | সেদিন ই আমার প্রথম চুরি করা ছিল আর সেদিন ই ধরা পরেছিলাম | কবিরের চাচা স্যার কাছে বিচার দিলে স্যার আমাদের ২ জন কে খুব মার মেরেছিল | তার পর থেকে আজ পর্যন্ত চুরি করার সাহস পায়নি |
কবির খুব ভালো ছাত্র ছিল কোনো কোনো পরিখাতে আমি আর কোনো কোনো পরীক্ষাতে কবির ১ম হত | তবু ও আমাদের মধ্যে কোনো ঝগড়া হত না |
মাঝে মাঝে অন্য কারো সাথে কবিরের কথা বলা দেখলে, খেলতে দেখলে কেন জানিনা আমার ভিসন রাগ হত | আমি ও কবিরের কে দেখিয়ে দেখিয়ে অন্যদের সাথে গল্প করতাম, খেলা করতাম আর খেয়াল করতাম কবির ও রেগে আছে তবু ও আমরা একে অপরের সাথে কখনো রাগারাগি করতাম না |
কিন্তু সেই প্রথমবার কবিরের সাথে আমার ঝগড়া হয়েছিল হয়ত কবির ইছে করেই আমার সাথে ঝগড়া করেছিল | আগে যদি জানতাম সেই ঝগড়া টাই হবে আমাদের শেষ দেখা, শেষ কথাপোকথন, তাইলে হয়ত কক্ষনোই কবিরের সাথে ঝগড়া করতাম না |
দেখতে দেখতে আমাদের ২ বছ কেটে গেল | ক্লাস ৫ এর বার্শিক পরীক্ষার ফলা ফলে কবির হয়েছিল ১ম আমি হয়ে ছিলাম ২য | আমি অনেক খুশি হয়েছিলাম যে কবির ১ম হয়েছে | ভালো রেজাল্ট হওয়াতে ঢাকায় বসবাসরত আমার চাচা বাবার কাছে আমাকে ঢাকা নিয়ে যেযে ভালো স্কুলে পরাসনার প্রস্তাব দেয় প্রথমে আমি খুব খুসি হয়ে সিলাম কারণ বাবা সব সময় বলত মা রে তুই পরাশোনা শেষ করে শিক্ষক হবি | আজ তুই পড়ছিস একদিন তুই অন্যদের পড়াবি |
সেদিন বিকেলে কবির কে এই কথা বলতে তার বাড়িতে গেলে কবির কোনো কারণ ছাড়া আমার সাথে ঝগড়া করে | বুঝতে পারিনি যে এটাই হবে কবিরের সাথে আমার শেষ দেখা, শেষ কথা | পরের দিন সকলে আমরা পরিবার সহ ঢাকায় চলে আসি | আর কখনই গ্রামে ফিরে আসিনি কখনো কবিরের সাথে দেখা ও হয় নি | শেষ বার যখন এসেছিলাম তখন কবির আর নেই, চলে গেছে না ফেরার দেশে, হয়ে গেছে রাতের আকাশ |
কবিরের ছোট চাচার কাছে সুনতে পেলাম বসর ২ য়েক আগে কবির রিদ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে | হয়ত ছোট বেলার কষ্টটা জমিয়ে রেখে রেখে রোগটাত বাধিয়েছিল | শেষ সময়ে কবির ছোট চাচা কে বলে গিয়েছিল সে রাহাকে অনেক বেশি ভালবাসে |
কবির চলে গেলে ও তার চাচার কাছে বলে গিয়েছিল সে আমাকে খুব ভালবাসে কিন্তু আমি . আমি আজ ও বলতে পারলাম না যে কবির আমি ও তোমাকে খুব ভালবাসি | জানি কোনো লাভ নেই তবু ও আজ ও আমি কবিরের জন্য অপেক্ষা করছি কারণ আমি চাইনা কবিরের অস্তিত আমার মধ্যে থেকে হারিয়ে যাক | আমি চাহি কবির বেছে থাক আমার মধ্যে , এই নিস্প্রান স্কুলের মাঝে | বাকি জীবন টা এই নিস্প্রান স্কুল এর সাথে আর কবিরের সাথে আমার ছোটবেলা মনে করে কাটিয়ে দিতে |
এটা আমার এক বন্ধুর লেখা গল্প অরিত্রীর ছেলেবেলা